সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার কোনো প্রাথমিক স্কুলে (School) ঢুকলে সহজেই খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে যাবেন। হাতের রেজিস্টার নিয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়মমাফিক সই করছেন, ক্লাসে শিক্ষকরাও হাজির, ব্ল্যাকবোর্ড ঝকঝকে করা হয়ে গেছে। অথচ বেঞ্চ-ডেস্ক ফাঁকা, খাতাপত্র খোলা হয়নি কোথাও। ছাত্রছাত্রী নেই — অথচ স্কুল চলছে!
কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গোটা দেশে যেসব স্কুলে একটিও ছাত্র নেই, সেই লজ্জাজনক তালিকায় এবার এক নম্বরে পশ্চিমবঙ্গ। যে রাজ্য একসময় শিক্ষার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর জাতীয় নেতাদের জন্মভূমি হিসেবে গর্ব করেছে, সেই রাজ্যেই এখন কয়েক হাজার স্কুল কেবল নিস্তব্ধতার প্রতিধ্বনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সংখ্যার খেলা আরও চিন্তার ভাঁজ ফেলবে ভ্রূকুটি কপালে। সারা দেশে যেখানে মোট ছাত্রবিহীন স্কুলের সংখ্যা আট হাজারের গণ্ডি ছুঁইছুই, তার অর্ধেকেরও বেশি একাই দখল করেছে পশ্চিমবঙ্গ। বাংলায় ছাত্রবিহীন স্কুলের সংখ্যা মোট তিন হাজার আটশো বারোটি। অথচ উল্টোদিকে আবার দেখা যাচ্ছে—এমন হাজার হাজার স্কুল রয়েছে যেখানে শিক্ষক বলতে মাত্র একজন। গোটা বিদ্যালয়ের সব ক্লাস, সব বিষয়, এমনকি প্রশাসনিক জটিলতাও তাকেই সামলাতে হচ্ছে। মোট ছয় হাজার চারশো বিরাশিটি এমন বিদ্যালয় পশ্চিমবঙ্গে আছে।
এর মধ্যেই কমতে শুরু করেছে ভর্তি। গত এক বছরে প্রায় নয় লক্ষ শিশুর নাম খাতা থেকে উধাও হয়ে গেছে। স্কুলের সংখ্যাও নামছে তালিকা থেকে। এ যেন শিক্ষাব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা এক অদ্ভুত সংকট—যেখানে শিক্ষক আছেন কিন্তু পাঠার্থী নেই, আবার পাঠার্থী আছে অথচ শিক্ষক প্রায় নেই বললেই চলে।
বিদ্যুৎ, টয়লেট থেকে মিড-ডে মিল নিয়ে রাজ্যের অবস্থা বিশেষ খারাপ না হলেও প্রযুক্তির ব্যবহারে ভয়ংকর পিছিয়ে রয়েছে বাংলা। ইন্টারনেটের নাগাল পায় মাত্র সতেরো হাজার চারশো একচল্লিশটি বিদ্যালয়। আগামী দিনের শিক্ষাব্যবস্থা যেদিকে এগোচ্ছে—ডিজিটাল ও দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার দিকে—সে দৌড়ে বাংলা শুরুতেই পিছিয়ে পড়ছে।
কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের সদ্য প্রকাশিত UDISE+ রিপোর্ট, ২০২৪–২৫, বলা হয়েছে-
- বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মোট স্কুলের সংখ্যা ৯৩৭১৫
- কম্পিউটার রয়েছে মাত্র ২২,৭২১টি স্কুলে
- বাংলায় ছাত্রবিহীন স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা মোট ১৭৯৬৫
- রিপোর্ট অনুযায়ী এবছর বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৩৭১৫
- সম্প্রতি শিক্ষক নিয়োগ সংখ্যাও ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাত্র ৫,৪৫০ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই সমান্তরাল বাস্তবতা কেবল পরিসংখ্যানের খেলা নয়, এগুলো আসলে এক প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে। যোগ্য শিক্ষক থেকেও শিক্ষার আলো যদি প্রাপকের কাছে পৌঁছয় না, অথবা প্রযুক্তি-দক্ষতার অভাবে শহর-গ্রামের ব্যবধান যদি বাড়তেই থাকে, তখন প্রশ্নটা শুধু শিক্ষার মান নিয়েই নয়—বাংলার ভবিষ্যৎ কোন পথে হাঁটবে সেই নিয়েই।