কলকাতার দুর্গোৎসব মানেই এখন শুধু প্রতিমা দর্শন আর থিম নয়, সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে মোবাইল ক্যামেরা। কারও হাতে সেলফি স্টিক, কেউ আবার মণ্ডপের ভিড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে বানাচ্ছেন ছোট ভিডিও বা জনপ্রিয় ভাষায় রিল। এই নতুন প্রবণতা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে যেমন বেড়েছে কৌতূহল, তেমনই অসন্তোষও বাড়ছে প্রতি বছর।
দর্শনার্থীর বিপাকে ডিজিটাল উন্মাদনা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাত্র এক মিনিটের ভিডিও তৈরি করতে বাস্তবে সময় লাগে অনেকটাই। ভিড় জমে থাকা মণ্ডপে এত দীর্ঘ সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শুট করার স্বাভাবিকভাবে অন্যদের চলাফেরায় অসুবিধা তৈরি করছে। বিশেষ করে বয়স্ক ও শারীরিকভাবে অক্ষম দর্শনার্থীদের জন্য পরিস্থিতি হয় আরও জটিল। অনেকে আবার ব্যস্ত ভিড়ের মাঝে ঝুঁকিপূর্ণ ভঙ্গিতে ছবি তুলতে গিয়ে বিপদের মুখেও পড়ছেন।
উদ্যোক্তাদের দোটানা
এই সমস্যার পাশাপাশি আরেকটি বাস্তবতাও আছে। কিছু ভাইরাল রিল বা ভ্লগের কারণে কোনও কোনও পুজো মণ্ডপে হঠাৎ ভিড় বেড়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। উদ্যোক্তাদের স্বীকারোক্তি, প্রচারে বড়সড় খরচ করার সামর্থ্য অনেক কমিটির নেই। সেখানে কয়েক সেকেন্ডের একটি রিল বিনা খরচেই হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে তাদের পুজো। তাই একেবারে ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভবও নয়, আবার পুরোপুরি অবাধে চালাতে গেল সমস্যার শেষ নেই।
নিয়ন্ত্রণ আর সুযোগের সমন্বয়
এই কারণেই এ বছর থেকে সামনে আসছে নতুন নিয়ম। অনেক মণ্ডপেই রিল নির্মাতাদের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা গেট বা আলাদা কর্নার। কোথাও দেওয়া হচ্ছে বিশেষ ভ্লগার কার্ড, যাতে ভিড়ের মধ্যে সবাই একসঙ্গে না ঢুকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে কাজ করতে পারেন। কারও কারও ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে—দ্রুত শুট করেই বেরিয়ে যেতে হবে মণ্ডপ থেকে। আবার কোন মণ্ডপে উদ্যোক্তারা নিজেরাই ভ্লগারদের দিয়ে ভিডিও বানিয়ে কমিটির সোশ্যাল মিডিয়া পেজে আপলোড করাচ্ছেন, যাতে ভিড় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রচারের লাভও ওঠে।
নজরদারির কড়াকড়ি
প্রায় প্রত্যেকটি কমিটির পক্ষ থেকেই পরিষ্কার জানানো হয়েছে, বিপজ্জনক ভঙ্গিতে রিল করা চলবে না। কারণ এখানে দর্শকদের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে গুরুত্ব পাচ্ছে। কেউ নিয়ম ভাঙলে সঙ্গে সঙ্গে হস্তক্ষেপ করবেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
নতুন ট্রেন্ডের সঙ্গে মানিয়ে পুজো
সব মিলিয়ে ছবিটা স্পষ্ট—কলকাতার দুর্গাপুজো এখন কেবল মণ্ডপসজ্জা বা প্রতিমা দর্শনেই সীমিত নয়। স্মার্টফোনে বন্দি হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত, আর সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বিপুল সংখ্যক রিল ও ভ্লগ। সমালোচনা থাকলেও আড়ালে-আবডালে উদ্যোক্তারাও মানছেন, এই ট্রেন্ডকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা আর সম্ভব নয়। তাই এ বার থেকে শুরু হচ্ছে এক নতুন অধ্যায়—দর্শনার্থীর স্বাচ্ছন্দ্য, ভ্লগারের প্রয়োজন আর পুজোর প্রচার—এই তিনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা।