পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের তরফে সধারণ নাগরিকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চাল, গম সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি বিতরণের জন্য খাদ্যসাথী প্রকল্প এবং খাদ্যসাথী কার্ড কার্যকর করা হয়েছিল। তবে সময় যত এগিয়েছে ততই খাদ্যসাথী প্রকল্প এবং খাদ্যসাথী কার্ড নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ জমা পড়েছে রাজ্য সরকার তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রেশন দোকান এবং রেশন ডিলাররা খাদ্যদ্রব্য বিতরণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম করে থাকেন। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় খাদ্যসাথী প্রকল্প সংক্রান্ত নানাবিধ অনিয়মের কারণে একজন ব্যক্তির খাদ্যসাথীর খাদ্যশস্য অন্য একজন ব্যক্তি পেয়ে যান, যার কারণে যোগ্য গ্রাহকেরা বারংবার বঞ্চিত হয়ে থাকেন।
আর এই সমস্ত অনিয়ম, দুর্নীতি উল্লেখ করে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্তারা খাদ্য দপ্তর থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বারংবার নানা ধরনের অভিযোগ জানাচ্ছিলেন। আর তাতেই খাদ্যসাথী প্রকল্প সংক্রান্ত এই সমস্ত অনিয়ম এবং দুর্নীতি দূর করতে উদ্যোগী হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। আর তাই এবারের রেশন তোলার নিয়মে এক বড়সড় পরিবর্তন আসতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে খাদ্য দপ্তররের তরফে প্রকাশিত তথ্যে।
রাজ্য সরকারের তরফে কার্যকরী রেশন তোলার এই নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:-
নতুন রেশন ব্যবস্থা সংক্রান্ত নানাবিধ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে, রাজ্য সরকারের তরফে এই প্রথম রেশন সংক্রান্ত দুর্নীতি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে রেশন ব্যবস্থা সংক্রান্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এমনটা নয়। ইতিপূর্বেও বারংবার রেশন সংক্রান্ত দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য রাজ্য সরকার তথা খাদ্য দপ্তরের তরফে নানা ধরনের নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। বর্তমানে রেশন গ্রাহকদের যাচাই করার জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে খুব শীঘ্রই এই পদ্ধতি বন্ধ করা হবে বলেই জানা গিয়েছে বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্যে। খাদ্য দপ্তরের তরফে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে আগামী দিনে চোখের রেটিনা স্ক্যান করার মাধ্যমে গ্রাহকদের রেশন প্রদান করা হবে। মনে করা হচ্ছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাতের ছাপ না মিললেও রেটিনা স্ক্যান অবশ্যই মিলবে, যার ফলে কেবলমাত্র যোগ্য রেশন গ্রাহকেরাই রেশন পাবেন এবং রেশন ব্যবস্থা সংক্রান্ত সমস্ত রকম দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা সম্ভব হবে।
কেন এই পদ্ধতি কার্যকর করা হলো?
রেশন সংক্রান্ত দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য ইতিপূর্বে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত রেশন গ্রাহকদের আধার কার্ডের সঙ্গে রেশন কার্ড লিঙ্ক করা নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে আধার কার্ড এবং রেশন কার্ড লিংক করা থাকলেও সবসময় বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে গ্রাহকদের আঙ্গুলের ছাপ মিলতে চায়না। বিশেষত বয়স্ক ব্যক্তি এবং শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা দেয়। তবে শুধুমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি কিংবা শিশুদের ক্ষেত্রে নয় অনেক ক্ষেত্রেই নানা কারণে প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের আঙ্গুলের ছাপ ও মিলতে চায় না। যার ফলে রেশন গ্রাহক এবং রিসন ডিলার উভয়কেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি এই বিষয়টি নিয়ে ইতিপূর্বে বারংবার গ্রাহক অসন্তোষের মুখে পড়তে হয়েছিল রেশন ডিলারদের। আঙ্গুলের ছাপ না মিটলে একজন গ্রাহককে রেশন দেয়ার ক্ষেত্রে রেশন ডিলাররা দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রথম যে পদ্ধতিটি অবলম্বন করা হয় তাহল, OTP বা ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড পদ্ধতি।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে রেশন তোলার ক্ষেত্রে যেসকল গ্রাহকদের আঙ্গুলের ছাপ মিলতে চায় না তাদের রেজিস্টার্ড মোবাইলে OTP পাঠানো হয়ে থাকে এবং এই OTP প্রদানের মাধ্যমেই রেশন গ্রাহকরা তাদের রেশন সংগ্রহ করে থাকেন। কিন্তু তিনবার OTP পাঠানো সত্ত্বেও যদি গ্রাহক তা প্রদান করতে না পারেন তবে উক্ত গ্রাহকের আধার নম্বর দেখেই তাকে রেশন প্রদান করা হয়ে থাকে। আর এই পদ্ধতিটি ম্যানুয়াল পদ্ধতি নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে গ্রাহকের অরিজিনাল আধার কার্ড পর্যন্ত চেক করা হয় না, যেকোনো কাগজে লেখা গ্রাহকের আধার নম্বর ভেরিফাই করার মাধ্যমে উক্ত গ্রাহককে রেশন দেওয়া হয়ে থাকে। আর এখানেই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফাঁক হয়ে যায়। ম্যানুয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তিই অন্য কোন ব্যক্তির রেশন সংগ্রহ করতে পারবেন। আর এই সমস্যা দূর করার জন্য রাজ্যের খাদ্য দপ্তরের তরফে চোখের রেটিনা স্ক্যান করার মাধ্যমে রেশন বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই পদ্ধতি কার্যকর করা হলে আগামী দিন কোনভাবেই কোনরকম দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের মাধ্যমে রেশন সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন রাজ্যের খাদ্য দপ্তরের আধিকারিকরা।
আরও পড়ুন:- মাধ্যমিক পাশের পর রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সেরা ৪ টি সরকারি স্কলারশিপ।
কবে থেকে এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে রেশন বিতরণ করা হবে?
খাদ্য দপ্তরের তরফে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, সমগ্র দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম রেটিনা স্ক্যান করার মাধ্যমে রেশন বিতরণের প্রক্রিয়া চালু করা হবে। ইতিমধ্যেই পাইলট প্রকল্প হিসেবে রাজ্যের প্রতিটি জেলার ৫ টি করে রেশন দোকানে এই নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে রেশন বিতরণের প্রক্রিয়া কার্যকর করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই সমগ্র রাজ্যজুড়ে রেশন গ্রাহকদের রেটিনা স্ক্যান করার মাধ্যমে রেশন বিতরণের প্রক্রিয়া কার্যকর করা হবে বলেই দাবি করেছেন খাদ্য দপ্তরের আধিকারিকরা। তবে এখানেই শেষ নয়, রেশন ডিলাররা যাতে অত্যন্ত সহজেই রেটিনা স্ক্যান করার মাধ্যমে রেশন গ্রাহকদের রেশন দিতে পারেন তা নিশ্চিত করার জন্য রেশন ডিলারদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে রাজ্য সরকারের তরফে, এমনটাই জানা গিয়েছে খাদ্য ভবন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে। এর পাশাপাশি রেশন ডিলারদের সুবিধার খাতিরে খাদ্য দপ্তরের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলের মাধ্যমেও রেশন বিতরণের এই নতুন পদ্ধতির টিউটোরিয়াল ভিডিওর প্রচার করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতে রেশন দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। মৃত গ্রাহকের রেশন কার্ড সারেন্ডার না করে ওই কার্ডের মাধ্যমে রেশন সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে অন্য ব্যক্তির রেশন কার্ডের মাধ্যমে নিজের বরাদ্দ রেশনের তুলনায় বেশি রেশন সংগ্রহ করা সমস্ত ঘটনারই নজির রয়েছে প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে। আর তাই এই সমস্ত দুর্নীতি বন্ধ করতে রাজ্য সরকারের তরফে এই নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো। তবে রাজ্য সরকারের তরফে কার্যকরী রেশন তোলার এই নতুন নিয়মের রেশন সংক্রান্ত সমস্ত প্রকার দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তরফে।