দুর্গাপূজা (Durga Pujo) যত ঘনিয়ে আসছে, শহরের অলিগলিতে ততই শোনা যাচ্ছে ঢাকের শব্দ। কিন্তু এবার সেই আনন্দের তালে এক অদৃশ্য ভয়ের ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। পুজোর আগেই পশ্চিমবঙ্গের বহু ঢাকি প্রতিবছর দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে ঢাক বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁদের অনেকেই এ বছর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন। কারণ রাষ্ট্রীয় যাচাই-বাছাই আর অযাচিত সন্দেহের চাপ তাঁদের উৎসব-পূর্ব প্রস্তুতিকে রীতিমতো সংকীর্ণ করে তুলেছে।
এক মাস পর পুজো, অথচ মুর্শিদাবাদের একাধিক ঢাকি জানিয়েছেন—ঢাক বাজানোর অনুশীলনের চেয়ে তাঁরা এ বছর বেশি সময় ব্যয় করছেন আইডি কার্ড, পুলিশি ক্লিয়ারেন্স এবং প্রমাণপত্র সংগ্রহ করতে। অভিযোগ উঠছে, দিল্লি, মুম্বই কিংবা গুরুগ্রামের মতো শহরে পুজোর মরশুমে গিয়ে অনেক ঢাকি স্থানীয় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ছেন। শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলায় তাঁদের ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ সন্দেহে আটকে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ।
পুলিশি হয়রানির আশঙ্কা এতটাই প্রকট যে কিছু ঢাকি এবার রাজধানী বা শহরতলির ডাক পেলেও যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। বাঁকুড়ার কয়েকটি গ্রামে ইতিমধ্যেই একাংশ ঢাকি দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে—এবার পুজোয় বাইরে বাজাতে যাবে না। তাঁদের অভিমত, “বছরের এই সময়টাতেই আয় হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু হেনস্থা সহ্য করার চেয়ে ঘরে থাকাই নিরাপদ।”
অন্যদিকে, ঢাকিদের এই সংকট নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—বাংলার শ্রমশক্তি দেশজুড়ে সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তাঁদের প্রতি সন্দেহ বা হয়রানি সহ্য করা যাবে না। স্থানীয় স্তরে ঢাকিদের পাশে দাঁড়িয়ে বিধায়করা আশ্বাস দিচ্ছেন কঠোর পদক্ষেপের।
কিন্তু বাস্তবতা হল—ঢাকিদের জীবিকার সবচেয়ে বড় ভরসা এই উৎসব। কলকাতায় যেখানে এক পারফরম্যান্সে আয় হয় কয়েক হাজার টাকা, দিল্লি-মুম্বইয়ের মতো শহরে সেই মূল্য দাঁড়ায় কয়েকগুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এ যাত্রা অনেক পরিবারের বছরের সঞ্চয়ের উৎস। তবু অনিশ্চয়তার ছায়ায় সেই স্বপ্নও ফিকে হয়ে আসছে এবার।
ফলে এই বছর দুর্গাপূজার আনন্দের ঢাক যখন কাঁপাবে প্যান্ডেল আর শোভাযাত্রা, তখন তার ভিতরে মিলেমিশে থাকবে ঢাকিদের নিজস্ব এক অস্থির সুর। তাই তাদের শুধু তাল-লয়ে নয়, মর্যাদা ও নিরাপত্তাতেও সমান গুরুত্ব দেওয়া আজ জরুরি। কারণ পুজোর আনন্দ তো পূর্ণ হয় তখনই, যখন ঢাকিদের হাতেই নিঃশঙ্কভাবে বাজে উৎসবের আসল রাগ।