রাতভর বৃষ্টি আর নদীর ফুলে ওঠা জল যেন এক ভয়াবহ সকাল উপহার দিল কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারবাসীকে। রবিবার সকাল থেকেই ফুঁসে উঠেছে তোর্সা, তিস্তা, জলঢাকা—সহ উত্তরবঙ্গের (North Bengal) প্রায় সমস্ত নদী। প্রথমে জলস্তর একটু একটু করে বাড়লেও দুপুর নাগাদ তা ভয়ানক রূপ নেয়। নদীর জল গ্রামে ঢুকে প্লাবিত করে একের পর এক এলাকা। কোথাও মাটির বাঁধ ভেঙে গেছে, কোথাও আবার ঘরে ঢুকে পড়েছে ভয়ঙ্কর স্রোত। মানুষ, গৃহপালিত পশু—সব কিছু ভাসিয়ে দিচ্ছে উত্তাল নদী।
মাথাভাঙা ১ ব্লকের কেদারহাট, হাজরাহাট, জোড়শিমুলি, গিলাডাঙা, বালাসি, কুরাপাতা—এইসব গ্রাম যেন পরিণত হয়েছে ছোট ছোট দ্বীপে। জল যখন ঘরে ঢোকে, তখন অনেকেই কোনওভাবে গাছের উপর বা ছাদে আশ্রয় নেন। স্থানীয় রাজকান্ত বর্মণ বলেন, “চার ঘণ্টা জলবন্দি থাকার পর প্রশাসনের নৌকা এসে আমাদের উদ্ধার করে। তখনও চারদিক শুধু জল।” প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী অন্তত দশ হাজার মানুষ এখন জলবন্দি।
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে কেদারহাটের জোড়শিমুলিতে। জলঢাকা নদীর বাঁধ ভেঙে ভেসে যান দয়ারাম বর্মণ ও তাঁর নয় বছরের ছেলে মৃন্ময়। মৃন্ময় বাড়ির ছাদ থেকে ভেসে যায় জলে, আর দয়ারাম হারিয়ে যান স্রোতের মধ্যে। রাতভর খোঁজ চালিয়েও তাদের উদ্ধার সম্ভব হয়নি। আলিপুরদুয়ারেও সাত জন ভেসে গিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে পাঁচজনকে উদ্ধার করা গেলেও দুজনের খোঁজ এখনো অজানা।
তুফানগঞ্জের রায়ডাক নদীর জল বাড়ায় মহিষকুচি ও নিউটাউন এলাকার একাধিক ওয়ার্ড জলমগ্ন। বক্সিরকুঠিতে কাঠ কুড়োতে গিয়ে চারজন ভেসে যান, যাদের সবাইকে পরবর্তীতে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। মেখলিগঞ্জের কুচলিবাড়ির ফকতের চরত ও সিংপাড়া চরে চারশোর বেশি বাড়ি এখনো জলের নিচে।
শহর কোচবিহারও কার্যত অচল। অন্তত দশটি ওয়ার্ডে হাঁটু সমান জল, পড়ে গেছে রাজবাড়ির রেলিংয়ের একটি অংশ। চকচকার শিল্পতালুকের বড় অংশ নিমজ্জিত। মাথাভাঙা মহকুমা হাসপাতালের পুরুষ বিভাগেও ঢুকে পড়েছে জল।
পরিস্থিতি সামাল দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাতেই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। নির্দেশ দেন প্রতিটি ব্লকে কন্ট্রোল রুম, ত্রাণ শিবির ও রান্নাঘর চালু রাখতে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ জানান, যেসব এলাকা প্লাবিত, সেখানকার মানুষদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পুরপ্রধান রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “পনেরো বছরে এমন বৃষ্টি হয়নি। রেকর্ড পরিমাণ জলেই এত ভয়াবহ পরিস্থিতি।” এখন প্রশাসনের নজর সব জায়গায়, তবে গ্রামবাসীর মুখে একটাই প্রার্থনা—আবার যেন একটু রোদ দেখা দেয়, আর নদী তার শান্ত চেহারায় ফিরে আসে।