সকালের পাহাড়ি বাতাসে আজ আর শান্তির ছোঁয়া নেই—চারদিক যেন থমথমে পরিবেশ। বৃষ্টির ধারাবাহিক তাণ্ডব, নদীর উগ্র স্রোত, পথঘাট বন্ধ আর যাত্রাপথে একের পর এক ভূমিধস। সব মিলে পুরো অঞ্চল এক অদ্ভুত আতঙ্কে ঢেকে গেছে। তাই চারধাম যাত্রা আপাতত বন্ধ। কেবল যাত্রাপথে আটকে পড়া পর্যটক বা তীর্থযাত্রী নয়, দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় মানুষরাও। কারণ পাহাড় এখন আর শুধুই পুণ্যক্ষেত্রের আধ্যাত্মিক আবেশে মোড়া নয়—এ যেন এক বিপর্যয়ের মঞ্চ।
স্থগিত চারধাম যাত্রা
কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে, অন্তত ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারধাম সফর পুনরায় শুরু করা যাচ্ছে না। বরফঢাকা হেমকুণ্ড সাহিবের পথও আপাতত তালাবদ্ধ। আবহাওয়ার উন্নতির প্রত্যাশায় মানুষ অপেক্ষায়, কিন্তু প্রতিদিন ভরা নদী, ধসে যাওয়া সড়ক, তটভাঙা গ্রাম সেই অপেক্ষাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
কার দোষ—প্রকৃতি না কি অন্য কারোর?
মন্দিরের পুরোহিত, স্থানীয় ব্যবসায়ী আর তীর্থযাত্রী সেবায় যুক্ত মানুষরা বলছেন, প্রকৃতির এই অগ্নিপরীক্ষা আকস্মিক কিছু নয়। তাদের অভিযোগ — “এই বিপর্যয় প্রকৃতির কোপ নয়, মানুষের লোভের ফল। পাহাড়ে দেবতা থাকবার জায়গায় বসানো হয়েছে বুলডোজার। গোটা এলাকায় এখন আতঙ্কের পাশাপাশি তীব্র ক্ষোভ। সেখান থেকেই উঠে এসেছে অভিযোগ—“ভগবানের পীঠকে সিমেন্ট-লোহায় ঢেকে দিয়েছে সরকার। তাই এই ঘটনা নিছকই কোনো দুর্ঘটনা নয়, এ যেন ঈশ্বরের অসন্তোষ।
ইতিহাসে ছিল সতর্কবার্তা
এই যুক্তিকে তারা দাঁড় করাচ্ছেন অতীতের ঘটনাগুলোর সামনে রেখেই। ২০১৩ সালের কেদারনাথের ভয়াল মেঘভাঙা বিপর্যয় এখনো অনেকের চোখে স্পষ্ট ভেসে ওঠে সতর্কবার্তার মতো। তাছাড়াও আগে, ১৯৭৬-এ একটি সরকারি কমিশন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল—বদ্রীনাথ আসলে এক নদীঘেরা ভঙ্গুর উপত্যকা, যেখানে অতিরিক্ত নির্মাণ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু সেই পরামর্শে কেউ কর্ণপাত করেননি বরং হাইওয়ে, হোটেল, রিসোর্ট আর বাঁধে ভরে গেছে উপত্যকা। পাহাড়ি জনতার যুক্তি অনুযায়ী, এই অবিবেচক উন্নয়নই আজকের বিপর্যয়ের বীজ বপন করেছে।
সরকারি সতর্কতা
রাজ্য সরকার অবশ্য আপাতত বিশেষ সতর্কতা জারি করে জানিয়েছেন: যাত্রীরা যেন আর কোথাও না এগোন। কারণ হাওয়া অফিস বলছে, ভারী বৃষ্টি এখনই থামছে না, বরং সামনের দিনগুলোতেও আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত সরকার হাইওয়ে বা নতুন বাঁধ নিয়ে বিতর্কের কোনো উত্তর দেয়নি।
দেবভূমির কঠিন প্রশ্ন
ঘটনার অন্তরালে যে বড় প্রশ্নটি ভেসে উঠছে, তা আর শুধুই স্থানীয় ক্ষোভ নয়। হিমালয়ের কোলে গড়ে ওঠা আধ্যাত্মিক এই পথের পরিচয় তাহলে কি বদলাচ্ছে? যে পথ প্রতিদিন হাজারো মানুষের কাছে ছিল আশ্রয় ও আস্থার জায়গা, তা কি এখন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে অরক্ষিত, বিপজ্জনক ধ্বংসভূমিতে?