পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের অন্যতম পরীক্ষা প্রাইমারি টেট নিয়ে বিতর্কের মেঘ কোনমতেই কাটছে না। আর তাতেই প্রাইমারি টেট এবং টেট সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে নানারূপ তথ্য উঠে আসছে। প্রথম থেকে প্রাথমিক টেট সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা। আর তাতেই যোগ্য বিচারের আশায় তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। যার ফলস্বরূপ আদালতের নির্দেশ অনুসারে নানাবিধ তদন্তের রিপোর্টে প্রাথমিক টেট সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। তবে প্রাথমিক টেট সংক্রান্ত দুর্নীতির জেরে কেবলমাত্র যোগ্য চাকরিপ্রার্থী কিংবা সাধারণ জনগণ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তা নয়, এর সাথে বর্তমানে যে সমস্ত শিক্ষক রাজ্যের প্রাইমারি স্কুল গুলিতে কর্মরত তাদের চাকরি এবং যোগ্যতা উভয় নিয়েই বারংবার প্রশ্ন উঠেছে।
আর এবারে প্রাথমিক টেট সংক্রান্ত আরো এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এলো, যার কারণে সমগ্র রাজ্যের সাধারণ জনগণ সহ বর্তমানে রাজ্যের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলগুলিতে কর্মরত শিক্ষকদের মাথায় রীতিমতো হাত পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি গৌতম পাল মহাশয় যোগদানের পরই জানিয়েছিলেন যে, আগামী দিনে কোনরকম দুর্নীতি ছাড়াই সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া মেনে প্রাথমিক টেটের মাধ্যমে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হবে। তবে পর্ষদের এই প্রতিশ্রুতিতে বিগত দিনের শিক্ষক দুর্নীতি সম্পর্কিত বিচার অথবা অনুসন্ধান কোনটাই বন্ধ হয়নি। আর তাতেই বিচার চলাকালীন একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায় অনুসারে, কলকাতা হাইকোর্টের তরফে প্রশিক্ষণহীন ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এমনটাই জানা গিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে।
চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক কোন কোন শিক্ষকদের চাকরি বাতিল হতে চলেছে:-
বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জানা গিয়েছে যে, ২০১৪ সালের টেটের পর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ প্রার্থীর অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হয়নি। বহু ক্ষেত্রে সংরক্ষণের নিয়ম না মেনেই চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও চাকরিপ্রার্থীদের শিক্ষক রূপে নিয়োগ করা হয়েছিল। পর্ষদের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জানা গিয়েছে যে উক্ত বছরে প্রাথমিক টেটের মাধ্যমে ৪২ হাজার ৫০০ জন চাকরিপ্রার্থীকে চাকরি দেয়া হয়েছিল। আর এই ৪২ হাজার ৫০০ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩২ হাজার শিক্ষকই তৎকালীন সময় প্রশিক্ষণ নেননি। এই তথ্য সামনে আসার পরই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে জানান যে, প্রশিক্ষণবিহীন এই ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করা হবে। অর্থাৎ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ অনুসারে, ২০১৪ সালের টেট এবং ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্যানেল অনুসারে যে সকল প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকদের নিয়োগ করা হয়েছিল তারা চাকরি হারাতে চলেছেন।
বাতিল হবে না সকলের চাকরি:-
যে সকল শিক্ষককে চাকরি বাতিল হয়েছে তাদের এবং তাদের পরিবারের কথা মাথায় রেখে কলকাতা হাইকোর্টের তরফে উক্ত শিক্ষকদের নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের আরও এক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, এই সকল শিক্ষকরা আগামী চার মাস কাজ করবেন। যার ফলে এদের কারো সার্ভিস ব্রেক হবে না। তবে এক্ষেত্রে তাদের পার্শ্ব শিক্ষকদের হারে বেতন প্রদান করা হবে। আগামী তিন মাসের মধ্যে নতুন করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগ করা হবে। যে সমস্ত শিক্ষকদের চাকরি বাতিল হয়েছে তারাও এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার মাধ্যমে পুনরায় শিক্ষক পদে চাকরি পেতে পারবেন। এর পাশাপাশি আদালতের তরফে আরো জানানো হয়েছে যে, নতুন করে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই সমস্ত শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তবে এই নিয়ম কেবলমাত্র সেই সকল শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বহাল হবে যারা অপ্রশিক্ষিত অবস্থায় চাকরি পাওয়ার পরে ইতিমধ্যেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু যে সমস্ত শিক্ষকরা এখনো পর্যন্ত কোনরূপ প্রশিক্ষণ নেননি তাদের চাকরি হতে পারে। তবে এই সমস্ত শিক্ষকরা আগামীদিনে প্রাইমারি টেট দিয়ে ইন্টারভিউ পেরিয়ে নতুন করে শিক্ষক রূপে চাকরি পেতে পারবেন।
স্থগিতাদেশ:-
বিচারপতি অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, যেসকল শিক্ষকদের চাকরি বাতিল হয়েছে তারা আগামী চার মাস চাকরি করতে পারবেন তবে তাদের পার্শ্বশিক্ষকদের হারে বেতন দেওয়া হবে। তবে আপাতরূপে এই নির্দেশের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করা হয়েছে বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিসিশন বেঞ্চের তরফে। ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ অনুসারে, আগামী ২৩ শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্ভিসে যুক্ত থাকতে পারবেন এই ৩২ হাজার শিক্ষক। এর পাশাপাশি এই চার মাস তাদের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন অনুসারী বেতন দেওয়া হবে এমনটাই জানানো হয়েছে বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের রায় অনুসারে। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়ার নির্দেশে কোনরূপ বদল আনা সম্ভব নয়। বিচারপতি অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশের পর কোনরূপ স্থগিতাদেশ জারি করা হয়নি। অর্থাৎ চাকরিক্ষেত্রে টিকে থাকতে গেলে এই ৩২ হাজার শিক্ষককে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে।
কি হতে চলেছে এই মামলার ভবিষ্যৎ?
প্রাথমিক টেট দুর্নীতি মামলা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের তরফে ৩২ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল সংক্রান্ত যে রায় দেওয়া হয়েছে তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন ওই সকল শিক্ষকরা। তাদের দাবি, তাদের আর নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া অংশগ্রহণের কোনোরূপ প্রয়োজনীয়তা নেই। যার জেরে আগামী দিনেই মামলার ভবিষ্যৎ কি হতে চলেছে তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় রয়েছেন যোগ্য চাকরিপ্রার্থী সহ পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ জনগণ। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের তরফে কি রায় দেওয়া হবে তা জানতেও রীতিমতো উৎসুক হয়ে রয়েছেন সমগ্র রাজ্যে সাধারণ মানুষ।
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায় এবং আদালতে স্থগিতাদেশ নিয়ে নানা প্রকার জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষ তথা সংশ্লিষ্ট মহলের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে। যদিও কলকাতা হাইকোর্টের রায় এবং স্থগিতাদেশ নিয়ে জনগণ রীতিমতো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন এই ৩২,০০০ শিক্ষককে পুনরায় সুযোগ দেওয়া উচিত এবং আগামী দিনে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে নতুন করে চাকরিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেয়া উচিত। আবার অনেকেই মনে করেছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায় একেবারে যথাযথ এবং তাতে কোনরূপ বদলের প্রয়োজন নেই। যদিও আগামী দিনে কি হতে চলেছে তা নিয়ে কোনরূপ স্পষ্ট রূপরেখা প্রকাশ্যে আনা হয়নি আইনজীবী অথবা মামলাকারী কিংবা আদালতের তরফে।